জীবন নিয়ে কিছু কথা – মানব জীবনের উদ্দেশ্য ও আনন্দ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের অধীনে নাছি কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পে মানুষদের সাথে কি দুর্বিষহ অত্যাচার করা হতো সে ব্যাপারে আপনি হয়তো এর আগেও নিশ্চয়ই শুনেছেন। কাউকে জীবন্ত অবস্তায় গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দিয়ে শ্বাস রুদ্ধ করে মেরে ফেলা হতো। তো কাউকে অকারণেই বা ভীষণই ছোট্ট একটা ভুলের কারণে পিটিয়ে মেরে ফেলা হতো।
All time international best selling book ‘MAN’S SEARCH FOR MEANING’ বইয়ের লেখক VIKTOR E. FRANKL সেই নাছি কন্সেনট্টেশন ক্যাম্পের কয়েদিদের মধ্যেই একজন ছিলেন। যারা শেষ অব্দি বেঁচে থেকে সেখান থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। আজ তারই লেখা বই থেকে আমি বলবো, সেই ভয়াবহ নাছি ক্যাম্পে দৈনন্দিন জীবনের সাথে আমাদের এখনকার দৈনন্দিন জীবনের ঠিক কী কী মিল রয়েছে এবং সেই জীবন সমস্যার সমাধান কি? তো চলুন, শুরু করা যাক।
সেই সময় সবাই এটা জানতেন যে, নাচি ক্যাম্পে মানুষদের উপর কি ভীষণই অত্যাচার করা হয়। তবু যখন কোন কয়েদিকে নাছি ক্যাম্পে ট্রান্সফার করার জন্য গাড়িতে তোলা হতো তখন সেই কয়েদি মনে মনে আশা করতো তার জন্য পরিস্থিতি হয়তো অতটাও খারাপ হবে না। যতটা সে অন্যদের মুখে গল্প শুনেছে। তার জন্য সব কিছু আলাদা হবে।
প্রথম দিন কলেজ বা অফিসে জয়েন করার আগে বাসে বা ট্রেনে ওঠার সময় বা একটা রিলেশনশিপের শুরুতে আমাদের মনের মধ্যেও ঠিক এই একই আশা কাজ করে। ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে আসি যে, বড় হওয়ার সাথে সাথে জীবন কেমন কঠিন ও জটিল হয়ে ওঠে। তবু সেদিন আমাদের সবার মনেই একটা আশার আলো থাকে যে হয়তো আমার জন্য সবকিছু আলাদা হবে।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পৌছানোর পর কয়েদিদের দুটো লাইনে ভাগ করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো। যার মধ্যে একটা লাইনে সবাইকে ইমিডিয়েটলি গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে মেরে ফেলা হতো। আর অন্য লাইনের কয়েদিদের দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করানোর কাজে লাগানো হতো। যদিও যারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতো তারা কেউই জানত না, যে কোন লাইনটার কি পরিণতি হতে চলেছে। সব কয়েদিরাই মনে মনে আশা করত, তারা যে লাইনটায় দাঁড়িয়ে আছে তার পরিণতি নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে।
জীবনে চলার জন্য যে মানুষ বা যে পথটাকে আমরা বেছে নেই তার পরিণতি কি হতে চলেছে তা আমরা কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারিনা। তবু যেটা আমরা বেছে নেই সেটার পরিণতি নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে এই আশায় আমরা করে থাকি। কনসেনট্টেশন ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর অন্যান্য কয়েদিদের উপর অমানুষিক অত্যাচার ছোট্ট ছোট্ট ভুলের জন্য বেধোরক মার এসব দেখে যে সমস্ত কয়েদিরা একটু মানসিকভাবে দুর্বল থাকতো তারা ভয়ে পাগলের মত হয়ে উঠতো। কিছুদিন পর তাদের মধ্যে অনেকেই এই ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পথ হিসাবে স্বেচ্ছায় কাটা তারে হাত দিয়ে ইলেক্টিক শক খেয়ে সুইসাইড করাকে বেছে নিত।
কলেজ বা অফিসে জয়েন করার বা রিলেশনশীপে কয়েক মাস বা কয়েক বছর পেরোনোর পর পরিস্থিতির জটিলতা ও কঠিনতা যখন অসম্ভব ভাবে বেড়ে ওঠে। তখন ঠিক কনসেনট্টেশন ক্যাম্পের কয়েদিদের মতোই মানসিকভাবে দুর্বল আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ এর হাত থেকে মুক্তি হিসেবে সুইসাইডকে বেছে নেয়। কনসেনট্টেশন ক্যাম্পের ভয়াবহতাকে মেনে নিয়ে এর যে সমস্ত কয়েদিরা বেঁচে থাকতেন। তাদের মধ্যে থেকে সমস্ত মানবিক অনুভুতিগুলো হারিয়ে যেত। যেমন ভালোবাসা, দয়া এগুলো সব হারিয়ে যেত এবং বিষয়টা হলো এই মানবিক অনুভূতি গুলো হারিয়ে যাওয়াটই সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য তাদের জন্য একটা ঢাল হিসেবে কাজ করতো। সমস্ত মানবিক অনুভূতি মুছে গিয়ে শুধুমাত্র পাশবিক অনুভূতি তাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকায় তারা সবসময় শুধু বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন, যেমন খাদ্য,বস্ত, এগুলো যোগাড় করার চিন্তায় সারাক্ষণ মগ্ন থাকতে পারতো।
উদাহরণস্বরূপ, একসময় যখন ক্যাম্পে TYPHUS রোগ ছড়িয়ে পড়ায় প্রচুর কয়েদির একসঙ্গে মৃত্যু ঘটে। তখন অন্যান্য কয়েদিরা সেই মৃতদেহগুলো দেখে চোখের জল ফেলার বদলে মৃতদেহগুলো থেকে জুতো, জামা, খাবার এসমস্ত জিনিস কুরিয়ে নেওয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিয়েছিল।
একইভাবে জীবনের জটিলতা ও কঠিনতাকে মেনে নিয়ে আমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নেই। তাদের মধ্যে থেকেও আস্তে আস্তে ভালোবাসা, দয়া এই জাতীয় মানবিক অনুভূতিগুলো হারিয়ে যেতে শুরু করে। আর তার পরিবর্তে সারাক্ষণ শুধু বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু দরকার যেমনঃ আরো টাকা, আরো ক্ষমতা এই সমস্ত চিন্তায় আমরা মগ্ন হয়ে থাকি। যার ফলে স্বাভাবিক আমাদের মধ্যেও একই রকম পাশবিকতা জন্ম নেয়।
একজন অত্যন্ত গরিব যার কাছে ১০০ টাকা মানে অনেক মূল্যবান। অন্যদিকে একজন ধনী মানুষের কাছে হয়তো ১০০ কেনো ১০০০ টাকাও অতটা জরুরী না। সেই মানুষটাও সুযোগ পেলেই সেই গরীব মানুষটার কাছ থেকে ১০০ টাকা ছিনিয়ে নিতে দ্বিধা বোধ করে না। যে সমস্ত কয়েদিরা শেষ পর্যন্ত বেঁচে থেকে ছাড়া পেয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই ছাড়া পাওয়ার পরও নরমাল ভাবে আর জীবন যাপন করতে পারেননি।
কারণ বাড়ি ফিরে তাদের মধ্যে অনেকেই দেখতে পায় তাদের পরিবার বন্ধু-বান্ধব কেউ বেঁচে আর বেঁচে নেই। এমনকি তাদের শহরেরই কোন অস্তিত্ব নেই, বা যদি কেউ পরিবারের কেউ বেঁচেও থাকতো। তবু তারা তাদের পরিবারের কাছ থেকে যে সহানুভূতি পাওয়ার আশা করে বাড়ি ফিরতো সেটা তারা কখনোই পেতনা। কারণ তাদের পরিবারের লোকেদের মতে তারাও রেসেনিং, বমবিং এই জাতীয় কষ্ট গুলো সহ্য করে বেঁচে ছিলেন।
তাই কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পের কয়েদি হওয়ায় বিশেষ সহানুভূতি পাওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করতেন না। ফলে নিজের প্রাপ্য সহানুভূতি না পাওয়ায় বাড়ি ফেরা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কয়েদিদের মধ্যে প্রতিশোধের হিংসা জেগে উঠতো। যেমনঃ অনেকেই এই ক্যাম্পের গার্ডদের হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতেন।
কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পর বউ ছেলেমেয়ে যদি সেবা-শুশ্রূষা না করে তাদের নিজেদের সমস্যার কথা বলতে শুরু করে তখন অনেকেই তাদের প্রাপ্য সহানুভূতি না পাওয়ায় একই রকম হিংস্র হয়ে ওঠেন। চাকরি জীবনে প্রতিটা মুহুর্তে রিটায়ারমেন্টের দিন গুনতে গুনতে বয়সকালে রিটায়ারমেন্টের পরও তারা সেই মন খুলে হাসতে বা ভালোবাসতে ভুলে যান।
কিন্তু এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যারা শেষ অব্দি বেঁচে ছিল। তাদের মধ্যে কিছু এরকম কয়েদি ছিল। যারা ভালোবাসা, দয়া এই সমস্ত মানবিক অনুভুতিগুলোকেই পাথেও করে সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও জীবনের মানে খুঁজে নিতে সফল হয়েছিল। আর কয়েদিরাই শুরু থেকে শেষ অব্দি এবং মুক্তি পাওয়ার পরও একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হিসেবে মানবিকতার সাথে জীবন কাটাতে পেরেছিল।
উদাহরণস্বরূপ, প্রচন্ড ঠাণ্ডায় একটা ছেড়া কাপড় পরিয়ে রেখে। তাদেরকে দিয়ে যখন কঠোর পরিশ্রম করা হতো। তখন কেউ কেউ কল্পনায় তার প্রিয় মানুষটার সাথে কথপোকথন চালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতো। কেউ কেউ নিজের সামান্য খাবার টুকু অন্য কেউ যার সেই খাবারটা তার থেকেও বেশি দরকার তার সাথে ভাগ করে নিয়ে জীবনের মানে খুজে পেত। কেউ কেউ সূর্য্যদয়, সূর্যাস্ত, ফুল ফোটা, পাখিদের গান গাওয়া এরকম প্রতিদিনকার প্রকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে সৌন্দর্য খুজে নিয়ে সেটা উপভোগ করে জীবনে বেঁচে থাকার মানে খুজে নিত। অনেক সময় মাত্র ত্রিশ মিনিটের লাঞ্চ ব্রেকে কয়েকজন দল বেধে এক জায়গায় হয়ে নাচ, গান, হাসির মধ্যে দিয়ে জীবনে বেঁচে থাকার মানে খুজে নিত।
স্কুলে ত্রিশ মিনিটের টিফিন টাইমে বদ্ধুদের সাথে খেলার আনন্দ, আমাদের মধ্যে ৬ঘন্টা ধরে একের পর এক ক্লাস করার অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা এনে দেয়।
কলেজ বা অফিসে সেই মানুষটার সাথে কথা বলতে পারা বা সামান্য চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার আনন্দটা আমাদের মধ্যে সারাদিনের অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা দেয়।
প্রিয় জনদের সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনযাপন উপহার দেওয়ার আনন্দ, আমাদের প্রতিদিনের অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা আনিয়ে দেয়। কিন্তু একটু লক্ষ করলে আপনিও বুঝতে পারবেন এই যে আনন্দ যেখান থেকে আমরা লড়াই করার শক্তি পাই। সেই আনন্দের উৎস কিন্তু ভালোবাসা, দয়া এই ধরনের মানবিক অনুভতিগুলোই।
তাই জীবনের জটিলতা বা কঠিনতার সাথে হার মেনে যদি আমরা এই মানবিক অনুভতিগুলোকেই জলাঞ্জলী দিয়ে দেই, তাহলে কিন্তু এই কঠোরতার মধ্যেও একজন প্রকৃত মানুষ হিসাব বেঁচে থাকার যে শক্তি দরকার সেটা আমরা সম্পূর্ন হারিয়ে ফেলি। ফলে হয় স্বেচ্ছা মৃত্যু বা পাশবিক ভাবে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। জীবন আপনার উপর অত্যাচার করুক, যতই কঠিন পরিস্থিতে নিয়ে ফেলুক। আপনার সব কিছু কেড়ে নিতে পারলেও যতক্ষণ আপনি বেঁচে আছেন, ততক্ষন অব্দি আপনার কাছ থেকে কেউ একটা জিনিস কেউ কোনো দিনও ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
আর সেটা হলো আপনি নিজের মনের ভিতর যেকোন পরিস্থিতির ব্যাপারে কি মানে বেছে নিবেন, সেটা বেছের নেওয়ার স্বাধীনতা।
জীবন প্রকৃত পক্ষে অর্থহীন আর সেই কারণেই প্রতি মূহূর্তে আপনার কাছে স্বাধীনতা থাকে। নিজের ইচ্ছে মত জীবনের অর্থ বেছে নেওয়ার। আর এটাই জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য।
আশা করি, লেখাটি আপনার মন ছুয়ে যাবে এবং আপনার ভিতরের মনুষ্যত্ববোধকে আরো তীব্রভাবে জাগিয়ে তুলবে। প্রিয়জন ও বন্ধু বান্ধবদের সাথে লেখাটি শেয়ার করে তাদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন।
আরো পড়ুন- কৌশলী হওয়ার উপায়