৭ টি শক্তিশালী রণতরী: এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা যুদ্ধ বিমান পরিবাহক হলো সেই রণতরী যা সমুদ্রে চলমান অবস্থায় একটি বিমান ঘাটি হিসেবে কাজ করে। এক কথায়, সমুদ্রে চলমান এয়ারবেস। যাতে একটি ফুল লেন্থ ফ্লাইট টেক থাকে। কোনো যুদ্ধ বা অপারেশন এর জন্য এখান থেকে সহজেই বিমান উড়ে যেতে পারে। আবার মিশন শেষে ফিরে এসে ল্যান্ডও করতে পারে।
এছাড়াও এতে মজুদ থাকে আধুনিক সমর অস্ত্র। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার সেই এলাকার কাছে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে এয়ার অ্যাটার্ক করা হবে। এটা করার কারণ হলো এয়ারবেস দূরে হওয়ার জন্য যাতে যুদ্ধবিমান গুলোকে বেশি দূরের পথ যেতে না হয়।
সেই সাথে অল্প সময়ের মধ্যেই মিশন শেষ করা যায়। এটি একটি নৌবাহিনীকে সারা বিশ্বের কাছে তার আকাশের শক্তি প্রদর্শন করে। স্থানীয় ঘাটিতে থাকা বিমান বাহিনীর কার্যক্রম ছাড়াই।
বর্তমান দিনে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর নেভিতে আধুনিক টেকনোলজিতে সুসজ্জিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে। আজ আমরা আলোচনা করবো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কয়েকটি বিমানবাহী রণতরী নিয়ে। যেগুলো সম্বন্ধে জেনে আপনি অবাক হবেন। ভাবতে থাকবেন একটা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এতবড় হয়। এত তার বহন ক্ষমতা থাকে। তো চলুন শুরু করা যাক-
No 1: Queen Elizabeth-Class Aircraft Carrier
এটা ইংল্যান্ডের একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। ২০১৭ সালে এটি রয়েল নেভিতে যুক্ত করা হয়। এটা লম্বায় ৮০ মিটার বা ২২০ ফুট এবং এর ডিসপ্লেসমেন্ট ৬৫ হাজার টন। এতে দুটি গ্যাস টার্বাইন ইঞ্জিন এবং চারটি ডিজেল ইঞ্জিন রয়েছে। এই সামুদ্রিক দানব এর গতিবেগ ২৫ নট বা ৪৬ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। এর রেঞ্জ ১৯০০ হাজার কিলোমিটার।
আর জানলে অবাক হবেন, কুইন এলিজাবেথ ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তার নিজের সাথে ১৬০০ ক্রূ মেম্বার নিয়ে যেতে পারে। সেই সাথে এটা একটানা ২৯০ দিন সমুদ্রে থাকতে পারে। এই বিমানবাহী রণতরীর উপর চল্লিশটি ফাইটার প্লেন এবং হেলিকপ্টার থাকতে পারে।
যেমন চিনিক অ্যাপাচি ৬৪ (chinook apache 64) এর মত হেলিকপ্টার এবং এইট থার্টি ফাইভ বি (835 b fighter plane)। এতে তিনটি সি আই ডব্লিউ এইচ ওয়েপন সিস্টেম (ciws weapon system) আছে। যার মাধ্যমে শত্রুপক্ষের অ্যান্টি শিপ মিসাইল এবং হেলিকপ্টারকে ধ্বংস করা যায়।
এছাড়াও কুইন এলিজাবেথ ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে থার্টি এম এম ডি এস থার্টি এম এমকে টু গানস (30mm ds30m mk2 guns) এবং মিনি গানস (Mini guns) আছে।
No 2: Admiral Kuznetsov, Russia
অ্যাডমিরাল কুজনেটসভ ব্রুজ নৌসেনায় ২৫শে ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে যুক্ত করা হয়েছিল। ২৯ নট গতিবেগ সম্পন্ন ৩০৫ মিটার লম্বা এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কিছুদিন আগে সিরিয়া সমস্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এর ডিসপ্লেসমেন্ট প্রায় ৬৫ হাজার টন। আর প্রপালশন সিস্টেমের মধ্যে আছে চারটি টারবাইন, ৯টি টার্বো জেনারেটর, আছে ৬টি ডিজেল জেনারেটর।
এই বিমানবাহী রণতরী ১৭০০ জন ক্রূকে নিয়ে ৪৫ দিন পর্যন্ত জলে থাকতে পারে। সন্দেহ না রেখেই বলা যায়, এটা আমেরিকার সুপার ক্যারিয়ার থেকে বেশ কিছুটা ছোট হলেও শক্তিশালী ঘাতক হাতিয়ার বহন করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এটাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
No 3: INS Vikramaditya, India
আইএনএস বিক্রমাদিত্য ভারতীয় নৌসেনাতে যোগদান করার পর ভারতের নৌসেনাতে ব্যাপক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের পৌরাণিক সম্রাট বিক্রমাদিত্য এর নাম অনুসারে এটির নামকরণ করা হয়েছে। এই রণতরী নিজের মধ্যে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে রেখেছে। চলুন, প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, এই রণতরীর পিছনের ইতিহাস-
সর্বপ্রথম ১৯৮৭ সালে সোভিয়েত নৌ বাহিনীতে এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটি যোগদান করে। তারপর সোভিয়েত ইউনিয়ন এর ভাঙনের পর এই এয়ারক্রাফট এর নামকরণ করা হয় অ্যাডমিরাল গর্সকভ (Admiral Gorshokov)। ১৯৯৬ সালে সামরিক বাজেট স্বল্পতার কারণে একে রাশিয়ান নেভি থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।
২০০৪ সালের ২০শে জানুয়ারি ভারত সরকার এটি ২.৩৫ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়। তারপর এটির আধুনিকায়নের জন্য বিনিয়োগ শুরু করে। অবশেষে ২০১৪ সালের ১৪ই জুন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এই রণতরী ২৮৩ মিটার বা ৯৩০ ফুট লম্বা। অর্থাৎ তিনটি ফুটবল মাঠের সমান বড়। কুড়ি তলা বাড়ির সমান উঁচু। আর ৪৪,৫০০ টন ভারী। অর্থাৎ সমুদ্রে চলমান অভেদ্য কেল্লা।
জাহাজটির অস্ত্রসজ্জায় রয়েছে চারটি একে৬৩০সিআইডব্লিউএস ওয়েপন সিস্টেম। বারাক ১ মিশাইল যা শত্রুপক্ষের লড়াকু জাহাজ এর হাত থেকে বাঁচাবে। এছাড়াও আছে বারাক ৮- লং রেঞ্জ সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। এই রণতরীর প্রোপারশন সিস্টেমে রয়েছে ৮টি টার্বোপেশারাইজড বয়লার, ৪টি জিয়ারেড স্টিম টারবাইন। যা ১৮০,০০০ হর্স পাওয়ার শক্তি উৎপন্ন করে।
এটি প্রতি ঘন্টায় ৫৬ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। অনেক দূর পর্যন্ত নজর রাখতে পারে এমন লং রেঞ্জ এয়ার সার্ভেইলেন্স রাডার লাগানো আছে। যেটা একে শত্রুপক্ষের হামলা সম্পর্কে আগে থেকেই তথ্য প্রদান করে। আইএনএস বিক্রমাদিত্য তার রাডারের সাহায্যে নিজের চারপাশে 500 কিলোমিটার এলাকার উপর নজর রাখতে পারে।
মিগ ২৯কে বিমানের দ্বারা আকাশ পথে দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্ব আর সমুদ্রে একটানা ৪৫ দিন থাকার ক্ষমতা এতে আছে। তাই বলা হয়, বিক্রমাদিত্য যেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে ওখানে তাঁর রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এই কারণে আইএনএস বিক্রমাদিত্যকে ভারতীয় রণ শক্তির দিক থেকে গেম চেঞ্জার হিসেবে দেখা হচ্ছে।
No 4: Cavour, Italy
পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট একটি দেশ হল ইতালি। আয়তন অনুযায়ী এটি ৭১ তম অবস্থানে রয়েছে। তা সত্ত্বেও ইতালিতে রয়েছে দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। এর মধ্যে একটি হলো ক্যাভর। এটি ২০০৪ সালে লঞ্চ করা হয়েছিল। আর ২০০৮ সালের ২৭ শে মার্চ ইতালি নৌসেনাতে কমিশন করা হয়।
এতে কুড়ি থেকে ত্রিশটা এয়ারক্রাফট এবং হেলিকপ্টার থাকতে পারে। এর মধ্যে হ্যারিয়ার কমব্যাট জেডও রয়েছে। প্রতি ঘন্টায় ৫৪ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এই রণতরী লম্বায় ৮০০ ফুট। এটি অন্যতম শক্তিশালী রণতরী।
প্রোপালশন সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে চারটি গ্যাস টারবাইন, ৬টি ডিজেল জেনারেটর। এটি নিজের সাথে ৪৮৬ জন ক্রূ, ২১১ জন এয়ার উইং, ১৪০ জন স্ট্যাফ এবং ৩৬০ জন ট্রুপস নিয়ে যেতে পারে। ২০১০ সালে হাইতিতে ভূমিকম্পের পর সেখানে উদ্ধারকার্য চালানোর জন্য এটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল।
No 5: Liaoning, China
বর্তমান চীনের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার লিওনিং এর কাহিনী বেশ অদ্ভুত। এটা মূলত সোভিয়েত রাশিয়াতে বানানো শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত নেভিতে যুক্ত হয়। তারপর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া যখন ভেঙে যায় তখন এটা বিক্রি হয়ে যায় ইউক্রেনের কাছে।
তারপর ১৯৯৮ সালে এটা চীন সরকার কিনে নেয়। তারপর এটা পুনরায় হস্তান্তরিত হয় চীনে। মেরামত এবং সংশোধনের পর ২০১২ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর চীনের নেভিতে এটা লিওনিং নামে যুক্ত হয়। কয়েকবছর আগে লিওনিং এর উপর চীন স্বদেশী প্রযুক্তিতে এটাকে মডিফাই করেছে।
লিওনিং লম্বায় ৩০৫ মিটার বা ৯৯৯ ফুট। এর উপর ৪০ টি এয়ারক্রাফট রাখা যায়। এর রেঞ্জ ৭১৩০ কিলোমিটার। এতে রয়েছে ৩৮৫৭ টি ঘর। যেখানে থাকতে পারে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। আর এত মানুষ নিয়ে এটি ৪৫ দিন পর্যন্ত সমুদ্রে থাকতে পারে।
No 6: Nimitz-class aircraft carrier
বন্ধুরা এবার আমরা যে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার সম্পর্কে জানতে চলেছি, এটার বৈশিষ্ট্য জেনে আপনি নিশ্চয়ই অবাক হবেন। এটা এতটাই বিশাল যে, এটাকে সুপার ক্যারিয়ার বলা হয়। এর নাম হলো নিমিটজ ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার।
এই বিমানবাহী রণতরী ৮৫ থেকে ৯০ টি বিমান ও হেলিকাপ্টার নিয়ে যেতে সক্ষম। এর ডিসপ্লেসমেন্ট ১ লক্ষ টন। আর লম্বায় ১০৯২ ফুট। বিগত ৪৩ বছর ধরে দশটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তার মধ্যে তিনটি নিমিটস ক্লাস আর সাতটি ইম্প্রুভ নিমিটস ক্লাস আমেরিকান নৌসেনাদের শোভা বাড়াচ্ছে।
এর প্রোপালশন সিস্টেমে আছে চারটি স্টিম টারবাইন আর দুটি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর। এর গতিবেগ ৩০ নট বা ৫৬ কিলোমিটার। এটি একসাথে ছয় হাজারের বেশি ক্রূ মেম্বারকে নিয়ে যেতে পারে, ভাবা যায়! এর রেঞ্জ আনলিমিটেড। কারণ এতে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর রয়েছে। যেটি একে অবিরাম শক্তি প্রদান করে।
এতে রয়েছে সি স্প্যারো মিসাইল এবং রোলিং এয়ার ফ্রেম মিসাইল। আগত দিনে অবশ্যই আরো উন্নত, আরো বড় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আসবে। কিন্তু এটা আমেরিকার নৌসেনাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
No 7: Gerald R.Ford-class aircraft carrier
পৃথিবীর প্রতিটা দেশ নিজেদের আরো শক্তিশালী করার জন্য অনবরত চেষ্টা করে চলেছে। সেই সূত্র ধরেই যদি আমেরিকার কথা বলা হয়, তাহলে বলা যায় আমেরিকা একের পর এক নতুন নতুন টেকনোলজি আবিষ্কার করে চলেছে।
২০১৭ সালে আমেরিকার নেভিতে যুক্ত হওয়া জেলার্ড আর ফোর্ড ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এর একটা বড় উদাহরণ। মনে করা হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। যার মুখোমুখি হওয়া আমেরিকার শত্রু দেশগুলোর পক্ষে মোটেও সহজ হবে না।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০১৭ সালের ২২ শে জুলাই ফোর্ড এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে নৌসেনাতে যুক্ত করেছে। এর নামকরণ করা হয়েছে ইউএসএ’র ৩৮ তম রাষ্ট্রপতি জেলার্ড আর্টফোর্ড জুনিয়র এর নাম অনুসারে।
এই বিশাল আকার জলদৈত্য ১১০৬ ফুট লম্বা। যেটা ১ লক্ষ টন পর্যন্ত হাতিয়ার বহন করে নিয়ে যেতে সক্ষম। এতে দুটি নতুন জেনারেশনের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর লাগানো হয়েছে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা আগের ক্যারিয়ারের তুলনায় আড়াই গুণ বেড়ে গেছে। এই কারণে এতে ৫০ বছর পর্যন্ত জ্বালানি প্রয়োজন হবে না। এটা বানানোর প্রধান উদ্দেশ্য হলো নতুন প্রজন্মের সাথে এগিয়ে চলা।
এর সাহায্যে আমেরিকা শত্রুপক্ষের উপর নিমেষে হামলা করতে পারে। এর রেঞ্জ আনলিমিটেড এবং এটি নিজের সাথে ২৬০০ ক্রূ নিয়ে যেতে পারে। এছাড়াও এতে রয়েছে অত্যাধুনিক Surface-to-air মিসাইলস, লঞ্চারস, গানস ইত্যাদি।
শেষকথা
তাই বন্ধুরা এই ছিল বিশ্বের কয়েকটি প্রধান বিমানবাহি রণতরীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়। লেখাটি পড়ে ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর প্রযুক্তি পাগল বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন। কমেন্ট করে জানান এরপর কোন টপিকের উপর আপনি লেখা পড়তে চান। কেননা, আপনাকে সাহায্য করতে পারাটাই আমাদের আসল উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন- পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর ৫ রাইডিং দেখে গা শিউরাবে