প্রেমের ধোঁকা: ভালবাসার মানুষ, শব্দটা শুনলেই কেমন যেন অনুভূতি আর বিশ্বাস অনুভূত হয়। এই বিশ্বাস আপনার ভালবাসার মূল্য বাড়িয়ে দিতে পারে আবার এই বিশ্বাসই দেয় জীবনের চরম মুল্য। আজ আমরা এমন বাস্তব জীবনে বিশ্বাস করে ভালবাসার ফাঁদে আটকে পড়া একটি মেয়ের হৃদয়বিদারক গল্প শুনব। যা আপনাকে জীবনের বড় ভুল থেকে রক্ষা করতে পারে।
১ম দৃশ্য: মায়াবতীর আগমন
বিচিত্র এ পৃথিবীতে শত নাম, শত অনন্যতার আগমন ঘটে প্রতিসময়ে। এমনি এক অনন্য মেয়ের আগমন ঘটে,যার শুরু বেশ কিছু বছর আগে কুয়াশাভরা কনকনে ভোর শীতে। কোন এক গর্ভধারিণী মায়ের কষ্টের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে,ভোরের আলো দেখতে উঁকি দেয় গোলাপি বর্ণের এক ফুটফুটে কন্যা শিশু। শুরুটা কষ্ট দিয়ে হলেও শেষ অব্দি ভালো হবে এমন প্রত্যাশা সব পিতা-মাতার।
কিন্তু সবার প্রত্যাশা পূরণ হলে হয়তো পৃথিবীতে কোন বৈষম্য থাকতো না। তাই স্রষ্টার লীলা-খেলায় মানুষ হর হামেশায় ছুটে নিজের প্রত্যাশা পূরণে। ছুটতে ছুটতে মানুষ কখনো ক্লান্ত হয়ে বেছে নেয় অন্য অবলম্বন,আবার কখনো অতি সুখের আশায় পড়ে যায় রহস্যময়ী মায়াজালে। এই মায়া-জালের অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় নি সাধারণ দশ জনের মতো গোলাপিও।
বাবা অতি আদরে গোলাপি মেয়েটির নাম রাখেন সুরভী কারণ বাবার ধারণা তার মেয়ের আগমনে আঙ্গিনার রঙ্গিন ফুলগুলো কয়েকগুণ বেশি সৌরভ ছড়াচ্ছে। শাসনহীন বাবার স্নেহ-আবদারে কেটে যাচ্ছে সুরভীর শৈশব জীবন। প্রচন্ড জেদী ও রাগী স্বভাবের হলেও পাথর মনে ফুল ফোটতে এতটুকু সময় লাগতো না কারো।
২য় দৃশ্য: স্বপ্নযাত্রা
আবেগে টুইটম্বুর এই মেয়েটির চোখের কোণে যেন সবসময় জল লেগে থাকতো। তাই বন্ধুরা খেপানোর জন্য তাকে কাঁদুনী বলেও ডাকতো। বেশ হতো যদি সময়টাকে আটকিয়ে রাখা যেত,কিন্তু তা তো হবার নয়। রঙ্গিন স্বপ্নগুলো নাটাইয়ের সুতো বেয়ে আকাশে মেলতে মেলতে কেটে যায় কতগুলো বছর।
সাধারণ মেয়ের মতো নিজের স্বপ্ন পূরণে সুরভী বেশ সচেষ্ট। ডাক্তার হওয়ার স্নপ্নটা শুধু তার নয় তার বাবা-মা সবার। তাই ক্লাসের প্রথম সারিতে অবস্থান সবসময়। শুধু যে পড়ালেখায় তা নয় সৌন্দর্যের দিক দিয়ে স্কুলে সবার আলোচনার শীর্ষে অবস্থান তার। লাল-নীল খামে ভরা প্রেমপত্র পাওয়াটা ছিল তার নৈমিত্তিক ব্যাপার, আর সব পত্রের একটাই উত্তর ছিল-“না”। কিন্তু ‘না’ শোনার পাত্র ছিল না শোভন।
৩য় দৃশ্য: অভিশপ্ত ভালোবাসার আগমন
এলাকার বখাটে ছেলেদের আইকনিক স্টার শোভন ভাই। মা মরা এই ছেলেটি বড় হয়েছে সৎ মায়ের অসৎ আচরণে। তাই তার চরিত্রে মিশে গেছে দুশ্চরিত্রের ছাপ। আপনজন বলতে কয়েকজন বন্ধু আর নেশাদ্রব্য। পাড়ার কয়েকজন সুদর্শন যুবকদের সে একজন। মায়াবী একটা ছেলে, যার চোখের মায়ায় যেকোন রূপসী হারিয়ে যেতে পারে। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা থেকে শুরু করে মেয়ে পোটানোর সব কায়দা জানা তার। সুরভীর সাথে শুরুটা না দিয়ে হলেও অন্যদের মত হাল ছাড়ে নি শোভন।
দিনের পর দিন লেগে থাকে তার পিছনে, রাত্রি বেলায়ও বাসার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে সে। এতসব পাগলামো সুরভীর ভয়ের কারণ হলেও ভাল লাগতো তার। কিন্তু ভবিষ্যৎ ও শোভনের কৃতকর্মের কথা ভেবে দশ পা পিছিয়ে নেয় সুরভি।
এদিকে শোভনের পাগলামো আরো কয়েকগুণ বেড়ে যেতে লাগল। একদিন ব্লেড দিয়ে হাত কেটে বড় করে সুরভীর নাম লিখে হাজির হয় সুরভীর কাছে, সবার সামনে হাটু গেড়ে করুণা সুরে জাহির করতে থাকে নিজের ভালবাসা। সুরভী ভয় পেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে আসে। আবেগময়ী মেয়েটার মনে হাজার প্রশ্নেরা ছুটোছুটি করে।
ভাবতে থাকে-শোভন সম্পর্কে সব পজিটিভ চিন্তাভাবনা,হয়তো শোভন বাবা-মায়ের শাসন অভাবে এরকম হয়ে গেছে, হয়তো সৎ মায়ের অত্যাচারে তার এরকম অবস্থা। কি সমস্যা তাকে মনের কোণে একটু ঠাঁই দিলে। কিন্তু বোকা মেয়েটি জানেনা যে সে অনেকদিন আগেই শোভনকে মনের ভিতর বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থান করে দিয়েছে। তাই বিবেকেরা ধীরে ধীরে তার আবেগের কাছে পরাজিত হতে শুরু করেছে।
৪র্থ দৃশ্য: মিষ্টি প্রেমের ফাঁদ
শুরু হয় অসম ভালবাসার নতুন অধ্যায়, আর শেষ হতে শুরু করে ভোরের আলোর বিস্তর দৈর্ঘ্য। নিজের ভালবাসাকে জাগিয়ে তুলতে সুরভী যে কখন গোধুলীর আলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা টেরই পায়নি। কারণ ভালবাসা নাকি অন্ধ, আর এই অন্ধ ভালবাসায় চলতে থাকে শোভনকে ভাল করার এক আপ্রাণ প্রচেষ্টা।
প্রচেষ্টাকে সফল করতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, নোট সংগ্রহের মিথ্যে অযুহাতে সুরভী প্রায়ই দেখা করে শোভনের সাথে। বদলে যেতে লাগল সময়,কিন্ত মিথ্যে বদলানোর অভিনয় শুরু করল শোভন। নির্ভরতার আশ্রয়ে,সন্তপর্নে বেচে থাকার তাগিদে সুরভীর নতুন এক পৃথিবী, যে পৃথিবীতে শুধু শোভন আর সুরভী। কল্পনার পৃথিবীতে বরাবরই ঢিল মারতে পটু বাস্তব পৃথিবীর মানুষগুলো। লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা পৃথিবী ধরা পড়ে যায় বাস্তবতার কাছে।
৫ম দৃশ্য: প্রেমের যন্ত্রণা
সুরভীর বাবা বিষয়টি সহ্য করতে না পেরে চেয়ারম্যানের কাছে শোভনের বিরুদ্ধে বিচার দিয়ে বসেন। মাদকদ্রব্য পাচারের দায়ে এর আগে বেশ কয়বার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল শোভন, কিন্ত কেউ চেয়ারম্যানের কাছে তার বিরুদ্ধে বিচার দিতে সাহস পায়নি কখনও। তাই অনেকটা ক্ষোভের মধ্যে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল সে।
তবে এই মাত্রাটা কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যখন সুরভী ভয়ে সবদোষ শোভনের উপর চাপিয়ে দেয়। নিরব শোভন একটা টু শব্দ পর্যন্ত না করে নীরবে শাস্তি মেনে নিয়েছিল সেদিন। কিন্তু সুরভীও বাদ পড়েনি,বাসায় এসে বাবা অনেক মারধর করে তাকে। যে বাবা ছোট থেকে একটা টোকাও দেয়নি,আজ কিনা সামান্য ভালবাসার দায়ে এভাবে মারছে তাকে? প্রচন্ড অভিমান শুরু হয় বাবার উপর। রাগের মাথায় বাসা থেকে পালিয়ে শোভনের কাছে আসে সারাজীবনের জন্যে।
৬ষ্ঠ দৃশ্য: প্রেমের ধোঁকা
ভালবাসার মানুষের দূর্বলতার সুযোগ নিতে কেউ ভোলেনা, তার উপর আবার শোভনের মত বখাটে ছেলে!! রাতের আধারে সুরভীকে নিয়ে নিকটবর্তী শহর ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেয় সে। ট্রেনের মধ্যেই সুরভী আবারও তার স্বপ্নগুলোকে সাজাতে শুরু করে। ছাত্রী ভাল হওয়ায় টিউশনি করে ভাল অর্থ উপার্জন করতে পারবে সে, আর শোভনকে কোন ছোট চাকুরীতে ঢুকিয়ে দেয়া যাবে।
দু’জনের ছোট সংসার কেমন হবে তার পুরো ছক আকতে শুরু করে। কিন্তু অভিমানী বোকা মেয়েটা জানে না যে নিজের জীবন সূর্যের অস্তমিত হতে যাচ্ছে। শোভনের কাধে স্বপ্ন দেখতে দেখতে সুরভী জিজ্ঞেস করে যে তারা ঢাকায় গিয়ে কোথায় উঠবে? জবাবে শোভন তার এক দু:সম্পর্কের চাচার বাসায় উঠবে বলে আশ্বাস দেয় তাকে। বলতে বলতে ব্যাগ থেকে পানির বোতল দিয়ে সুরভীকে একটু জিরিয়ে নিতে বলে। পানিটুকু খেয়ে সুরভীর মাথা ধরে উঠে,গভীর ঘুমে শোভনের কাধে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
৭ম দৃশ্য: ভালবাসার কষ্টের গল্প
সকালে ঘুম থেকে চোখ খুলতেই চোখের সামনে দেখতে পেল একজন মোটা মহিলা তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শোভন কোথায় বলে, ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে। নির্লজ্জের মতো মহিলাটি চেচিয়ে বলল-শোন ছেড়ি,তোর বয়ফ্রেন্ড তোকে আট লাখ টাকার বিনিময়ে আমাদের কাছে বিক্রি করে দিছে। তুই এখন ঢাকার বিখ্যাত জায়গায় আছিস,যেখানে বড় বড় লোকদের নিত্য আনাগোনা।
বেশি চিল্লাচিল্লি করবিতো এখানেই জিন্দা পুতে দিবো। নিজের কান,চোখ কোনটাই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। শোভন তার সাথে এমনটা করতেই পারেনা। আতঙ্কে কাঁদতেও পারছে না সে। বাবা-মায়ের মুখ দু’খানা ভেসে আসে চোখের সামনে। চারদিক শুধু দেয়াল আর দেয়াল। খুব কষ্ট করে ভাঙ্গা-ভাঙ্গা কণ্ঠে মহিলাটিকে বলল-আমাকে প্লিজ যেতে দিন,আমি বাসায় গিয়ে সব টাকা পাঠিয়ে দিবো।
একটা অতৃপ্ত হাসি দিয়ে মহিলা আবারও চেঁচিয়ে বলে- এইখানে যে একবার আসে,সে শুধু লাশ হয়েই যেতে পারে। বলতে না বলতেই বড় একটা সিরিজ তার শরীরে বিধে দেয়া হয়। শরীরে এক মাদকতা কাজ করতে শুরু করে সুরভির,আফছা চোখে দেখতে পায় একজন মধ্যবয়স্ক লোক যেকিনা সুরভির দুই হাত খাটের মধ্যে বেঁধে ঝাপিয়ে পড়ে সুরভীর ক্লান্ত, দুঃখ ভারাক্রান্ত শরীরটার উপর। সুরভির গলাটা ধরে এসেছে তাই চিৎকার করার শক্তিটুকূ নেই। চোখের কোণ বেয়ে অঝরে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু।
শেষ দৃশ্য: একজন পতিতা মেয়ে
তারপর তারপর আর বলতে পারছি না। আমার গলাটাও ধরে আসছে মনে হয়। এটা গল্প হলে ভাল হোত কিন্ত এ তো নির্মম বাস্তবতাকেও হার মানায়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজ কানে মেয়েটির মুখে এই নিষ্ঠুর কাহিনীটি শোনার পর থেকে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। আরো অবাক হয়েছিলাম যখন শুনি দেশের বড় বড় ব্যক্তি যাদের মানুষ একনামে চেনে তারাও তার কাস্টমার!!
যে মেয়েটির সাদা এফ্রোন পড়ে প্যারাসিট্যামলের কার্যকারিতা পড়ার কথা ছিল, আজ সে মেয়েটি ইয়াবা,ফেনসিডিল নিয়ে ব্যস্ত। ভোরের আলো দেখতে আসা মেয়েটির মত অনেক মেয়ে আছে যাদের একসময় ভোরের আলো দেখা হয় না। কিছু মিষ্টি স্বপ্ন আর ক্ষতবিক্ষত স্মৃতি আগলে রেখে, বাকি জীবন বেহিসেবি কাটিয়ে দেয় গোধুলীর আড়ালে। লুকোচুরি খেলতে না চাওয়া মেয়েটি একজীবন অনায়েসে কাটিয়ে দেয় নিজেকে লুকিয়ে রেখে। কিন্তু খুব সহজে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নগুলোর পিছে কতটা গভীর না বোঝা লুকিয়ে থাকে আমরা কি তা জানি??
এই লেখাটি ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে দেখতে নিচের ভিডিওতে ক্লিক করুন-
আরও পড়ুন- বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রেমপত্র- Bangla love letter